দেহে প্রবিষ্ট ব্যাকটেরিয়া (Bacteria) ধ্বংসে দুধরনের ফ্যাগোসাইটিক কোষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:
ক. ম্যাক্রোফেজ ও
খ. নিউট্রোফিল।
১. ম্যাক্রোফেজ (Macrophage: গ্রিক makros = lurge; phagein = eat, অর্থাৎ big eaters):
মনোসাইট হচ্ছে বৃক্কাকার ও দানাহীন সাইটোপ্লাজমবিশিষ্ট শ্বেত রক্তকণিকা দেহের মোট শ্বেত রক্তকণিকার ৪ শতাংশ মনোসাইট। অস্থিমজ্জার স্টেমকোষ থেকে উৎপন্ন হয়ে এসব কোষ ১০-২০ ঘন্টা রক্তে সংবহিত হওয়ার পর কৈশিকনালির প্রাচীরের ভিতর দিয়ে টিস্যুতে অভিযাত্রী হয়ে ফুলতে শুরু করে এবং প্রায় ৫ গুণ বড় হয়ে ৬০-৮০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়। পরিণত এ মনোসাইটকে ম্যাক্রোফেজ বলে। কিছু ম্যাক্রোফেজ সারা শরীরে পরিভ্রমণ করে, অন্যগুলো স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট টিস্যুতে (যেমন- ফুসফুস, যকৃত, বৃক্ক, যোজক টিস্যু, মস্তিষ্ক ও বিশেষ করে লসিকা গ্রন্থি ও প্লীহা) অবস্থান নেয়। প্রয়োজনে এখানে ম্যাক্রোফেজ ৪০ মাইক্রোমিটার/মিনিট গতিতে ক্ষণপদীয় চলনের সাহায্যে স্থানান্তরিত হয় এবং বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত জীবিত থাকে। ম্যাক্রোফেজ দেহে প্রবিষ্ট বিজাতীয় পদার্থের প্রতি ইমিউন সাড়াদানে মূল ভূমিকা পালন করে। তখন মনোসাইটগুলো টিস্যুতে অভিযাত্রী হয়ে ম্যাক্রোফেজে পরিণত হয়। ম্যাক্রোফেজের উপস্থিতি দেখেই ধারণা করা যায় যে দেহে বহিরাগতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ইমিউনতন্ত্রের মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ম্যাক্রোফেজ নিউট্রোফিলের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ফ্যাগোসাইট হিসেবে কাজ করে। তখন একেকটি ম্যাক্রোফেজ প্রায় ১০০টির মতো ব্যাকটেরিয়া গ্রাস করতে পারে, কখনওবা সম্পূর্ণ লাল রক্তকণিকা, ছত্রাক বা ম্যালেরিয়ার জীবাণুর মতো বড় পদার্থও গ্রাস করে। ম্যাক্রোফেজ এসব পদার্থ গ্রহণ ও পরিপাক শেষে অপাচ্য অংশ বহিষ্করণের পরও অনেক সময় জীবিত থাকে এবং আরও কয়েক মাস সক্রিয় থাকে। সাইটোকাইন (cytokine) নামক রাসায়নিক বার্তাবাহক ক্ষরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কোষকে একত্রিত করে ক্ষত নিরাময়ে ভূমিকা পালন করে।
২. নিউট্রোফিল (Neutrophils):
নিউট্রোফিল হচ্ছে ১২-১৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসসম্পন্ন, ২–৫ খন্ডবিশিষ্ট। নিউক্লিয়াসযুক্ত (খন্ডগুলো পরস্পরের সাথে সূক্ষ্ম তত্তুর সাহায্যে যুক্ত) ও সূক্ষ্ম দানাময় সাইটোপ্লাজমবিশিষ্ট শ্বেত রক্তকণিকা দেহের মোট শ্বেত রক্তকণিকার ৬০-৭০ শতাংশই নিউট্রোফিল। এসব কণিকা ক্ষণপদীয় চলন প্রদর্শন করে (৪০ মাইক্রোমিটার/মিনিট) এবং অস্থিমজ্জার স্টেমকোষ থেকে উৎপন্ন হয়। একজন স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক মানুষে দৈনিক প্রায় ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) নিউট্রোফিল উৎপন্ন হয়। এক সপ্তাহের মধ্যে পরিণত নিউট্রোফিলে রূপ নেয়। এগুলো ক্ষণস্থায়ী রক্তকণিকা, রক্ত প্রবাহে প্রবেশের পর ১২ ঘন্টা থেকে ৩ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকে, তবে টিস্যুতে প্রবেশ করলে কিছুদিন বেশি বাঁচে। কণিকাগুলো যেহেতু ক্ষণজীবী তাই দেহের সুরক্ষায় কখন এসব কণিকার প্রয়োজন পড়ে সে কারণে বিপুল সংখ্যক নিউট্রোফিল অস্থিমজ্জায় সব সময় মজুদ থাকে। অস্থিমজ্জার বাইরে সংবহিত ১০০ বিলিয়ন নিউট্রোফিলের মধ্যে অর্ধেক থাকে টিস্যুতে বাকি অর্ধেক রক্ত বাহিকায়। যেগুলো রক্তবাহিকায় থাকে তার অর্ধেক থাকে মূল ও দ্রুত রক্তস্রোতে, বাকি অর্ধেক চলে ধীরে সুস্থে রক্তবাহিকার অন্তপ্রাচীর ঘেঁষে (সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন টিস্যুতে প্রবেশ করতে পারে)।নিউট্রোফিল হচ্ছে সক্রিয় ফ্যাগোসাইটিক শ্বেত রক্তকণিতা। এগুলো বহিরাগত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা যে কোনো আণুবীক্ষণিক প্রোটিন কণা গ্রাস করে নেয়। কণিকার অভ্যন্তরে লাইসোজোম যে সক্রিয় প্রোটিওলাইটিক এনজাইম ধারণ করে রাখে তার সাহায্যে গৃহীত বস্তু ধ্বংস করে। নিউট্রোফিলের পক্ষে ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে বড় পদার্থকে গ্রাস করা সম্ভব হয় না। একটি নিউট্রোফিল ৩-২০ টি ব্যাকটেরিয়া গ্রাস করতে পারে। এরপর সেটি নিজেই নিষ্ক্রিয় হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
ফ্যাগোসাইটোসিসঃ
(Phagocytosis: গ্রিক phagein = to eat; kytos = cell;
olsis = process কোষভক্ষণ প্রক্রিয়া)
যে প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা দেহরক্ষার অংশ হিসেবে ক্ষণপদ সৃষ্টি করে দেহে অনুপ্রবেশকারী জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস প্রভৃতি) বা টিস্যুর মৃতকোষ ও অন্যান্য বহিরাগত কণাকে গ্রাস ও এনজাইমের সাহায্যে ধ্বংস করে দেহকে আজীবন সুস্থ রাখতে সচেষ্ট থাকে তাকে ফ্যাগোসাইটোসিস বলে।
ফ্যাগোসাইটোসিসের ধাপসমূহ (Steps of Phagocytosis):
১. ম্যাক্রোসাইটের সক্রিয় হওয়া (Activation of macrpcytes): জীবাণু সংক্রমণের ফলে প্রদাহস্থলে ক্ষতিগ্রস্ত রক্তকণিকা, টিস্যু বা রক্তজমাট থেকে উৎপন্ন কাইনিন, হিস্টামিন, প্রোস্টাগ্লান্ডিনস ইত্যাদি রাসায়নিকে উদ্দীপ্ত হয়ে ম্যাক্রোসাইটগুলো (ম্যাক্রোফেজ/নিউট্রোফিল) কৈশিকনালির প্রাচীর ভেদ করে ক্ষতস্থানে অভিযাত্রী হয়। ম্যাক্রোসাইটগুলো যখন সংক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন রাসায়নিক ক্ষরণে উদ্দীপ্ত হয়ে ক্ষতস্থানে জড়ো হতে থাকে সে প্রক্রিয়াকে বলে কেমোট্যাক্সিস (chemotaxis)।
২. অণুজীব ভক্ষণ (Ingestion): সক্রিয় হওয়ার পর ক্রমশঃ অণুজীবের দেহতলের সংস্পর্শে এলে ফ্যাগোসাইটে (ম্যাক্রোফেজ ও নিউট্রোফিল) দ্রুত যে ভৌত-রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে তার ফলে ফ্যাগোসাঁইট ক্ষণপদ সৃষ্টি করে অণুজীব ভক্ষণে উদ্যত হয় এবং মাত্র ০.০১ সেকেন্ডে একটি ব্যাকটেরিয়াম ভক্ষণ সম্পন্ন করতে পারে।
৩. ফ্যাগোজোম সৃষ্টি (Formation of phagosome): অণুজীব ভক্ষণের উদ্দেশে ফ্যাগোসাইট ক্ষণপদ বের করে ব্যাকটেরিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে এবং ক্ষণপদের মাঝে সৃষ্ট গহ্বরে আবদ্ধ করে। দুদিক থেকে আসা ক্ষণপদের অগ্রভাগ আরো এগিয়ে পরস্পর একীভূত হয়। এভাবে সৃষ্ট ঝিল্লিবেষ্টিত থলিকাটি ফ্যাগোজোম নামে পরিচিত। ফ্যাগোসাইটের সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত অ্যাকটিন ও অন্যান্য সংকোচনশীল তন্তু ফ্যাগোজোমের চতুর্দিক ঘিরে রাখে । এসব তন্তুর সংকোচনে ফ্যাগোসাইটের ঝিল্লি থেকে ফ্যাগোজোম সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে ঝিল্লিবেষ্টিত থলিকার মতো চালিত হয়।
৪. ফ্যাগোলাইসোজোম সৃষ্টি (Formation of phagolysosome): আবদ্ধ ব্যাকটেরিয়াসহ ফ্যাগোজোম সাইটোপ্লাজমের অভ্যন্তরে পরিযায়ী হয়। এ সময় সাইটোপ্লাজমে অবস্থিত গোল, ঝিল্লিবেষ্টিত ও হাইড্রোলাইটিক এনজাইমপূর্ণ দুএকটি লাইসোজোম নামক কোষ অঙ্গাণু ও অন্যান্য সাইটোপ্লাজমিক দানা ফ্যাগোজোমের ঝিল্লির সঙ্গে একীভূত হয়। একীভূত লাইসোজোম থেকে ব্যাকটেরিয়ানাশক (bactericidal agents) ও পরিপাক এনজাইম (digestive enzyme) ফ্যাগোজোমে ক্ষরিত হয়। ফ্যাগোজোমটি তখন ঝিল্পিবেষ্টিত একটি পরিপাক থলিকা (digestive vesicle)-য় পরিণত হয়। থলিকাটিকে ফ্যাগোলাইসোজোম বলে।
৫. ব্যাকটেরিয়ার অন্তঃকোষীয় মারণ ও গাচন (Intracellular killing and digestion of bacteria): ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস ও পরিপাকের জন্য লাইসোজোম ফ্যাগোজোমের সঙ্গে একীভূত হয়ে দুধরনের রাসায়নিক পদার্থ ক্ষরণ করে। গ্রাসের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যাকটেরিয়ার চলন, রেচন জননসহ যাবতীয় কার্যকলাপ রূদ্ধ হয়ে যায়।
৬. অপাচ্য অংশসহ ব্যাকটেরিয়ার অবশেষ (Residual body containing indigestible materials): ফ্যাগোজোম ঝিল্লিবেষ্টিত পরিপাক গহ্বর হওয়ায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস বা হজমের কোনো পর্যায়ে ক্ষতিকর কোনো অংশ ফ্যাগোলাইসোজোমের সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করতে পারে না। তবে উপযুক্ত পুষ্টি পদার্থ উৎপন্ন হলে তা ফ্যাগোজোমের সাইটোপ্লাজমে শোষিত হয়।
৭. বর্জ্যপদার্থ নিষ্কাশন (Discharge of waste materials): বেশি সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া গ্রাস করায় এবং তা পরিপাকের পর বর্জিত বিষাক্ত পদার্থ সঞ্চয় বা লাইসোজোমের ধ্বংসাত্মক রাসায়নিক পদার্থ সঠিকভাবে ফ্যাগোজোমে পতিত না হয়ে ফ্যাগোসাইটের সাইটোপ্লাজমে মুক্ত হওয়ায় প্রতিটি নিউট্রোফিলই মৃত্যুবরণ করে। অন্যদিকে, ম্যাক্রোফেজ উৎপন্ন বিষাক্ত ও অপাচ্য অংশ ত্যাগ করে নতুন ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসে তৎপর হয়।
আরও দেখুন...